ভোল্টেজ বলতে বোঝায় বিদ্যুতের সেই অভিনব শক্তি, যা দুটি পয়েন্টের মধ্যে বৈদ্যুতিক চার্জ চলাচলের জন্য প্রয়োজন হয়। একে বৈদ্যুতিক বিভব পার্থক্য, বৈদ্যুতিক চাপ, বা বৈদ্যুতিক টানও বলা হয়। সহজ করে বললে, ভোল্টেজ ঠিক সেই শক্তি যা একটি সার্কিটে চার্জকে ঠেলে পাঠায় আর এর ফলেই তোমার বেড-রুমের লাইট জ্বলে ওঠে, ফ্যান ঘুরে, এবং প্রিয় ডিভাইসগুলো প্রাণ পায়! একটু ভেবে দেখো তো, একটি ব্যাটারি বা জেনারেটর ছাড়া আমাদের জীবন কেমন হতো? ঠিক এই ব্যাটারি আর জেনারেটরই আমাদের ভোল্টেজের প্রধান উৎস। ভোল্টেজ ছাড়া বিদ্যুৎ ব্যবস্থা কল্পনাই করা যায় না, এটা যেন বিদ্যুতের মূল চালিকাশক্তি !
চিত্রঃ সার্কিটে ব্যবহৃত ভোল্টেজের চিহ্ন
ভোল্টেজ এবং “পোটেনশিয়াল ডিফারেন্স” প্রায় একই অর্থ বহন করে এবং অনেক সময় একে অপরের বিকল্প শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পোটেনশিয়াল ডিফারেন্সকে তুমি একটি সার্কিটের দুই পয়েন্টের মধ্যে শক্তির পার্থক্য হিসাবে চিন্তা করতে পারো। এই পার্থক্য কে ভোল্টে মাপা হয়, যা থেকে বুঝা যায় যে একটি পয়েন্ট থেকে অন্য পয়েন্টে ইলেকট্রনকে সরাতে ঠিক কতটা শক্তি প্রয়োজন।
বিভব পার্থক্য যত বড় হবে, সার্কিটে তত বেশি গতিতে ইলেকট্রন চলাফেরা করবে। ইলেকট্রনের গতি যত বেশি হবে, বাল্বের ক্ষেত্রে আলোর তীব্রতা তত বেশি হবে বা মোটরের ক্ষেতে ঘূর্ণন তত বেশি হবে। সহজ কথায়, পোটেনশিয়াল ডিফারেন্স বিদ্যুতের চালকের মতো! এটি বিদ্যুৎকে এমনভাবে কাজ করায়, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে আরও সহজ এবং রোমাঞ্চকর করে তোলে। সুতরাং, যখনই তুমি বৈদ্যুতিক ডিভাইস চালু করবে, মনে রাখবে এর পেছনে কাজ করছে এই অসাধারণ শক্তি!
আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি একটি সাধারণ AA ব্যাটারি, যা ১.৫ ভোল্ট শক্তি দেয়, সেটিকে একটি ২২০ ভোল্টের স্ট্যান্ডার্ড বৈদ্যুতিক আউটলেটের সাথে তুলনা করলে কি কি পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়? পার্থক্যটা বিশাল, তাই না? ভোল্টেজ যত বেশি হয়, ইলেকট্রনকে ঠেলে দেওয়ার “শক্তি” তত বেশি। একটি ১.৫ ভোল্টের ব্যাটারি দিয়ে কখনই মোবাইল ল্যাপটপের মত বড় ডিভাইস চালানো যাবে না, অপরদিকে ২২০ ভোল্টের আউটলেটে যদি কোন ছোট ডিভাইস কানেক্ট করা হয় (যার ধারণক্ষমতাই ১.৫ ভোল্ট) তাহলে সেটি অকার্যকর বা নষ্ট হয়ে যাবে। এর মূল কারণ হলো ডিভাইস ভেদে ভোল্টেজের চাহিদা ও ধারণক্ষমতা ভিন্ন।
চিত্রঃ AA ব্যাটারি
ভেবে দেখো, AA ব্যাটারি গুলো ছোট ছোট খেলনা বা রিমোট কন্ট্রোল অপারেট করতে ব্যবহৃত হয়, অপরদিকে ২২০ ভোল্ট আউটলেট দিয়ে ফ্রিজ, টিভি, এমনকি ওয়াশিং মেশিনের মতো বড় বড় যন্ত্র চালানো সম্ভব! ঠিক এভাবেই ভোল্টেজ আমাদের জীবনে ছোট থেকে বড়, সব ধরনের কাজ সহজ করে তোলে।
আশা করি এখন থেকে যখনই তুমি একটি ব্যাটারি বা আউটলেট দেখবে, তখনই তোমার চোখে ভেসে উঠবে এদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এই রহস্যময় শক্তির অজানা পার্থক্য!
এখন চলো আমরা ভোল্টেজের প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা করি। ভোল্টেজ মূলত দুই প্রকার:
1. DC (Direct Current) ভোল্টেজ।
2. AC (Alternating Current) ভোল্টেজ।
DC ভোল্টেজ
DC ভোল্টেজ (Direct Current Voltage) হলো একটি স্থির বা একমুখী ভোল্টেজ, যা সবসময় একটি নির্দিষ্ট দিকে প্রবাহিত হয়। এটি কোনো পরিবর্তন ছাড়াই একটি নিরবচ্ছিন্ন বৈদ্যুতিক প্রবাহ সরবরাহ করে।
উদাহরণস্বরূপ, ব্যাটারি থেকে প্রাপ্ত ভোল্টেজ হলো DC ভোল্টেজ, যেখানে বৈদ্যুতিক চার্জ সবসময় একটি নির্দিষ্ট দিকে চলে। সরল ভাষায় বললে, DC ভোল্টেজ হলো সেই ভোল্টেজ যা কখনো দিক পরিবর্তন করে না এবং একটি স্থির মান বজায় রাখে।
চিত্রঃ DC ভোল্টেজ
AC ভোল্টেজ
AC ভোল্টেজ (Alternating Current Voltage) হলো এমন একটি ভোল্টেজ, যার মান এবং দিক সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। এটি অনেকটা ঢেউয়ের মতো বারবার উপরের এবং নিচের দিকে ওঠানামা করে। এটি একটি পর্যায়ক্রমিক (periodic) প্রকৃতি অনুসরণ করে এবং সাধারণত Sine Wave আকারে হয়। তবে শুধু Sine Wave নয়, বরং দিক পরিবর্তন করে এমন যেকোন Wave বা তরঙ্গকেই আমরা AC Voltage বলবো। সরল ভাষায়, AC ভোল্টেজ হলো সেই ভোল্টেজ যা একবার এক দিকে এবং পরের মুহূর্তে উল্টো দিকে প্রবাহিত হয়। আমাদের ঘরের বিদ্যুৎ সংযোগ AC ভোল্টেজের উদাহরণ, যা পাখা, বাতি, এবং অন্যান্য গৃহস্থালি যন্ত্র চালায়।
চিত্রঃ AC ভোল্টেজ
ভোল্টেজ মাপার পদ্ধতি
এখন যেহেতু আমরা ভোল্টেজ সম্পর্কে জানি, চলো এখন দেখি কীভাবে এটি পরিমাপ করা যায়। আমরা অনেক সময় শুনেছি, একটি ৯ ভোল্টের ব্যাটারি বা ১২ ভোল্টের ভোল্টেজ সোর্সের কথা। এই ভোল্টেজকে পরিমাপের জন্য ব্যবহার করা হয় ভোল্টমিটার।
চিত্রঃ ভোল্টমিটার
ভোল্টমিটার হলো এমন একটি ডিভাইস যা AC এবং DC উভয় সার্কিটের ভোল্টেজ পরিমাপ করতে ব্যবহৃত হয়। সার্কিটের দুই পয়েন্টে ভোল্টমিটারের দুইটি প্রোব (পজেটিভ ও নেগেটিভ) সংযুক্ত করলে, এটি সেই দুই পয়েন্টের মধ্যে ভোল্টেজ ড্রপ পরিমাপ করে।
চিত্রঃ ভোল্টেজ পরিমাপ
এভাবেই আমরা সহজেই যেকোন সার্কিটের এবং যেকোন ইলেকট্রিক কম্পোনেন্ট এর মধ্যকার ভোল্টেজ ড্রপ খুব সহজেই পরিমাপ করতে পারি। বাসা কিংবা ল্যাবে কাজ করার ক্ষেত্রে ভোল্টমিটার একটি আদর্শ যন্ত্র যার মাধ্যমে অতি দ্রুত ও কম সময়ে আমরা DC ও AC ভোল্টেজ পরিমাপ করতে পারি।
আজ এই পর্যন্তই, পরের টিউটোরিয়ালে আমরা কারেন্ট নিয়ে বিস্তারিত জানবো।
আল্লাহ হাফেজ।