রোবটিক্স কি? রোবটের প্রকারভেদ, ব্যবহার, সুবিধা ও অসুবিধা।
আচ্ছা, ‘রোবটিক্স’ শব্দটি কোথা থেকে এসেছে? ভাবছেন, শব্দের মধ্যেই তো উত্তর লুকানো। রোবট থেকে রোবটিক্স। কিন্তু এই ‘রোবট’ শব্দটির উৎপত্তি কোথায় বলতে পারেন? রোবট শব্দটি এসেছে চেক শব্দ ‘Robota’ বা ‘Roboti’ থেকে, যার অর্থ হচ্ছে ‘শ্রমিক’। এর থেকেই নিশ্চয়ই ধারণা করা যাচ্ছে, রোবটিক্সের উৎপত্তি হয়েছে মানুষের শ্রমকে কমিয়ে, জীবন-যাত্রা সহজ করার জন্যই। এই রোবটিক্সের আদ্যোপান্ত সহজভাবে আপনাদের জানানোর চেষ্টাই থাকবে আজকে তাই চলুন প্রথমেই জেনে নেই রোবটিক্স কি?
রোবটিক্স কী?
এমন একটি যান্ত্রিক ব্যবস্থা, যার কাজকর্ম, চলাফেরা দেখলে মনে হবে এটি স্বয়ংক্রিয় ক্ষমতা সম্পন্ন বা নিজে থেকেই চিন্তা করে, বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করছে। কিন্তু আসলে এর কাজ চলে কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে। যে প্রোগ্রামের নিয়ন্ত্রন আর কারো নয় বরং মানুষেরই দখলে। আর বিজ্ঞানের যে শাখায় এই রোবট নিয়ে আলোচনা, গবেষণা ও উৎপাদন সংক্রান্ত কাজ করা হয়, সেটিই রোবটিক্সের জগত।
রোবটিক্সের ইতিহাস
এযুগের রোবটিক্স প্রায় পুরোটাই কম্পিউটারের উপর নির্ভরশীল হলেও, রোবটিক্সের ধারণা কিন্তু কম্পিউটার আবিষ্কারের বহু আগের। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ সালেই গ্রীক গণিতবিদ আর্কিটাস একটি বাষ্পচালিত যান্ত্রিক পাখি তৈরি করেন। নাম দেন ‘The Pegion’। ১৯৫০ সালের দিকে আবিষ্কার হওয়া লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির নোটবুকগুলোতেও পাওয়া যায় মাথা, চোয়াল নাড়াতে ও বসতে পারা যান্ত্রিক মানবের নকশা।
এরপর পেরিয়ে গেছে বহু বছর, আবিষ্কার হয়েছে কম্পিউটারের মতো যুগান্তকারী যন্ত্র। ১৯৫৪ সালে, অর্থাৎ বিংশ শতাব্দিতেই প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামকে কাজে লাগিয়ে ডিজিটাল রোবট তৈরি করেন জর্জ ডেভল। নাম দেন ‘ইউনিমেট’ (Unimate) । বিশ্বের প্রথম সফল ডিজিটাল রোবটিক্সের ফল ইউনিমেটের কাজ ছিলো জিনিসপত্র ওঠানামা করানো ও সরানো।
তারপর ১৯৬৬ সালে আবিষ্কার হয় বিশ্বের প্রথম আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন রোবট ‘শেকি রোবট’। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আবিষ্কৃত রোবটটির বিশেষত্ব ছিলো- চারপাশের বাঁধা বিপত্তি দেখে চেনা এবং চলার পথে আসা বাঁধাকে এড়ানো বা অতিক্রম করা।
এরপর তো রোবটিক্সের শুধুই এগিয়ে চলা। ঠিক মানুষের মতোই বুদ্ধিমান রোবট যে আর ভবিষ্যতবাণী না, তা তো ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ঘুরে যাওয়া রোবট ‘সোফিয়া’কে দেখেই বুঝেছেন। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্যে সেন্সর ও ক্যামেরা ব্যবহার করে নতুন নতুন জিনিস শেখার ক্ষমতা আছে তার।
রোবটের প্রকারভেদ
ছোট্ট থেকে বড়, সব রোবটেরই রয়েছে নিজস্ব ভিন্নতা। যেকারনে নির্দিষ্ট করে রোবটের প্রকারভেদ করা আসলে সহজ নয়। তবুও বৈশিষ্ঠের উপর ভিত্তি করে এদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করাই যায়।
১. অটোনমাস মোবাইল রোবট
মূলত প্রোগ্রাম করে দেয়ার পর সরাসরি মানুষের সাহায্য ছাড়াই বিরতিহীনভাবে কোন নির্দিষ্ট কাজ করতে পারা রোবটগুলো অটোনমাস মোবাইল রোবটের অন্তর্ভুক্ত। বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ভারী জিনিসপত্র ওঠা-নামা করানো, পরিস্কার করা, প্যাকিং, ড্রিলিং, ওয়েল্ডিংয়ের মতো একঘেয়ে কাজগুলোয় মানুষের পরিবর্তে এই ধরণের রোবটগুলো ব্যবহার করা হয়। এদের গতিবিধি থাকে ফিক্সড।
২. অটোমেটেড গাইডেড ভেহিকল
অনেকটা অটোনমাস মোবাইল রোবটের মতো কাজ করলেও, এর ভিন্নতা হচ্ছে এটি চাকার সাহায্যে মার্ক করা লাইন, তার, রেডিও ওয়েভ, লেজার কিংবা ম্যাগনেটকে অনুসরণ করে চলাচল করতে পারে। এর ব্যবহারও শিল্পকারখানায় ব্যপক। বিশেষ করে ভারী মালামাল ওঠানামা, পরিবহণ ও স্থানান্তরে। তবে সমতল জায়গাতেই এই রোবটগুলো ভালো চলাচল করতে পারে।
৩. আর্টিকুলেটেড রোবট
শিল্পক্ষেত্রে বহুল ব্যবহার হওয়া আরেকটি রোবট হচ্ছে আর্টিকুলেটেড রোবট। তবে শিল্পক্ষেত্রের অন্যান্য রোবটের তুলনায় এটি বেশি ব্যবহার উপযোগী। কারণ হচ্ছে এর জয়েন্টযুক্ত শরীর। জয়েন্টের কারনে এটি অনেকটা মানুষের হাতের মতো নড়াচড়া করতে পারে। পারে স্বাধীনভাবে উপর-নিচে বা চারদিকে ঘুরতেও। এই সুবিধার কারনে এটি অটোনমাস মোবাইল রোবটের চেয়েও বেশি কার্যকরী ভাবে ভারী জিনিস তুলতে পারে।
৪. হিউম্যানয়েড
মানবদেহের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ রোবটগুলো হচ্ছে হিউম্যানয়েড। মেশিন লার্নিংয়ের সাহায্যে এতে যুক্ত হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। এদের এই বুদ্ধিমত্তা এতোটাই উন্নত করা হচ্ছে যে, এরা পারে নিজে থেকে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে, কথা বলতে, উত্তর দিতে। মানুষের আচরণকে হুবহু নকল করতে পারার ক্ষমতার সাথে, আছে আবেগও। হিউম্যানয়েডের কথা উঠলে আবারো বলতে হয় ‘সোফিয়া’র কথা। সম্প্রতি এই বুদ্ধিমান রোবট মানবী নাকি ‘মা’ হওয়ারও ইচ্ছা প্রকাশ করেছে!
৫. কোবট
‘কোলাবরেশন’ এবং ‘রোবট’ এই দু’টি শব্দ নিয়ে ‘কোবট’। এই ধরনের রোবটগুলো মানুষের সাথে কোলাবরেট করে বা মিলে একত্রে কাজ করতে পারে। শিল্পকারখানায় বা বিভিন্ন কাজের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত অন্যান্য রোবটের সাথে মানুষের কাজ করা অনেক ক্ষেত্রেই ঝুঁকিপূর্ণ। এদিক দিয়ে কোবট আকারে অনেকটাই ছোট ও কম গতির হওয়ায়, এগুলোর সাথে মানুষের পাশাপাশি থেকে কাজ করা নিরাপদ। অনিরাপদ স্পর্শ বা সংঘর্ষ এড়াতেও কোবটে থাকে বিশেষ ব্যবস্থা। মোটরগাড়ি শিল্পে, ধাতু ঢালাইয়ের মতো কাজে এর ব্যবহার বেশি।
৬. হাইব্রিড
কাজের ক্ষমতার পরিধি বৃদ্ধির লক্ষে দুই বা ততোধিক ভিন্ন ধরণের রোবট একসাথে যুক্ত করে একটি নতুন রোবট প্রস্তুত করা হলে, সেটিকে বলা হয় হাইব্রিড রোবট। যেমন ধরুন, একটি অটোনমাস মোবাইল রোবটের সাথে আর্টিকুলেটেড রোবটের জয়েন্টযুক্ত রোবটিক হাত যুক্ত করে দিলে, এর কাজের ক্ষমতা বেড়ে যাচ্ছে দ্বিগুণ।
রোবট ব্যবহারের ক্ষেত্রসমুহ
বর্তমান বিশ্বে নানান ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে রোবট ও রোবটিক্স। তাদের মধ্যেই কয়েকটি নিয়ে জানা যাক।
- বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য ব্যপক হারে রোবটের ব্যবহার হচ্ছে। এতে অনেকাংশে কমছে বিপদজনক কাজের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের হতাহত বা প্রাণহানির ঝুঁকি।
- ডাক্তার, নার্স বা রোগীদের কাছে প্রয়োজনীয় জিনিস, ওষুধ দ্রুত পৌছাতে স্বাস্থ্যখাতে রোবটের ব্যবহার হচ্ছে। ইতোমধ্যেই আয়ারল্যান্ডের একদল ডাক্তার মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারে রোবটের সফল ব্যবহার করে দেখিয়ে দিয়েছে বিশ্বকে। শরীরের কোন অঙ্গহানিতে ব্যবহার হচ্ছে রোবটিক হাত-পায়ের মতো অঙ্গ। এছাড়াও হাসপাতাল পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতায় অটোনমাস মোবাইল রোবট কাজে লাগছে কোন কোন যায়গায়।
- বীজ বপন, আগাছা পরিষ্কার, মাটি বিশ্লেষণ, ফসল সংগ্রহসহ নানান কাজে রোবট কাজ করছে কৃষিক্ষেত্রেও।
- রোবটিক সুইপার, রোবটিক ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, পুল ক্লিনারসহ বিভিন্ন ঘরোয়া রোবট ব্যবহার করছে বিশ্বজুড়ে প্রচুর মানুষ। অনেক হোটেল, রেস্টুরেন্টেও খাবার আনা-নেওয়া ও পরিবেশনার কাজ করছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রোবট।
- বোমা চিহ্নিতকরণ, মাইন অপসারন ও বোমা নিষ্ক্রিয়করণ রোবট, ড্রোন, চালকহীন রোবট বিমান সহ রোবটিক্সের অত্যাধুনিক কিছু আবিষ্কার কাজ করছে যুদ্ধ ও সামরিকক্ষেত্রেও। সেই দিন হয়তো দূরে নেই, যখন রোবট সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রে লড়বে মানুষের হয়ে।
- বিভিন্ন প্রাকৃতিক বা কৃর্ত্রিম খনি আছে, যেগুলো বিষাক্ত, দুর্গম ও মানুষের কাজের জন্য বিপদজনক। সেসব ক্ষেত্রে মানুষের নিরাপদ বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে রোবটের।
- সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ায় বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের জন্য রোবট শিক্ষক ব্যবহার শুরু হয়েছে। যাদের বলা হচ্ছে ‘টেলি-প্রেজেন্স’ রোবট।
- মঙ্গল গ্রহে পাঠানো মার্স রোভার থেকে নাসার রোবোনট, পৃথিবীর গণ্ডি পেড়িয়ে মহাকাশেও বিচরন করছে অত্যাধুনিক রোবটেরা।
রোবটের যত অসুবিধা
মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ ও সুবিধাজনক করতে রোবট নিরলসভাবে কাজ করলেও, এরও রয়েছে নানান অসুবিধাজনক দিক। কী সেগুলো?
- রোবট ও এই সম্পর্কিত সব যন্ত্রপাতির দাম এখনো অনেক মানুষের হাতের নাগালে আসেনি। তাই রোবট ব্যবস্থাপনা ও রক্ষনাবেক্ষন যথেষ্ট ব্যয়বহুল।
- কৃর্ত্রিম বুদ্ধিমত্তা না থাকার কারনে বেশিরভাগ রোবটেরই নেই কোন সৃজনশীলতা, তাই এগুলো ভুল করলেও বুঝতে পারে না।
- নানান ক্ষেত্রে রোবট ব্যবহারের ফলে বিশ্বজুড়ে প্রচুর মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে।
- মানুষের মতো সব রোবট পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না, যদি না তার প্রোগ্রাম পরিবর্তন করা হয়।
- রোবট নির্ভর শিল্পকারখানায় রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, দক্ষ টিম ও বিদ্যুৎ প্রয়োজন। রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, দক্ষ টিম ও বিদ্যুৎ প্রয়োজন, তার অভাব।
পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে রোবট নিয়ে গবেষণা ও ব্যবহার হচ্ছে বহুদিন ধরেই। তবে খুশির খবর হচ্ছে, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম আগ্রহী হচ্ছে রোবটিক্স শিক্ষা ও চর্চার উপর। এই আগ্রহ ধরে রেখে সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজনের পাশাপাশি, রোবটিক্সের যন্ত্রপাতি সহজলভ্য করা গেলে, অন্যান্য উন্নত দেশের কাতারে বাংলাদেশের নামও পোছানো হবে সময়ের ব্যাপার মাত্র।
This is very helpful 😊
Thank you
Thanks
welcome