ইলেক্ট্রিক্যাল বা ইলেক্ট্রনিকসের বিভিন্ন কাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া হচ্ছে সোল্ডারিং। আর সোল্ডারিং করার কাজে ব্যবহৃত হয়, এমনই একটি অপরিহার্য যন্ত্র হচ্ছে তাতাল। ইলেক্ট্রিকাল যন্ত্রপাতির তৈরি থেকে শুরু করে সার্ভিসিং, বোর্ডের উপর কিছু ঝালাই করে লাগানো বা খোলা, ইত্যাদির মতো নানান যায়গায় রয়েছে এই তাতালের ব্যবহার। বিশেষ করে ইলেক্ট্রনিকস নিয়ে যারা কাজ করেন বা পড়াশোনা করেন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে, তাদের জন্য তো তাতাল ব্যবহার জানা ছাড়া গতিই নেই বলা চলে। আজকে সহজ ভাষায় জানার চেষ্টা করবো এই সোল্ডারিং আয়রন বা তাতালেরই খুঁটিনাটি।
সোল্ডারিং আয়রন বা তাতাল কী?
যেহেতু সোল্ডারিং কাজের যন্ত্র সোল্ডারিং আয়রন বা তাতাল, তাই তাতালের ব্যাপারে জানতে হলে আগে জানতে হবে সোল্ডারিং প্রক্রিয়া নিয়ে। সোল্ডারিং কী? সোল্ডারিং হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে দুই বা ততোধিক ধাতুকে কিংবা ইলেকট্রিক কম্পোনেন্টকে একে অপরের সাথে কোন জোড়ক পদার্থ দিয়ে তাপ বা বিশেষ কোন শক্তি প্রয়োগ করে জোড়া লাগানো হয়। এই তাপ বা বিশেষ শক্তি প্রয়োগ করতে যে বিশেষ যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয়, সেটিই হচ্ছে সোল্ডারিং আয়রন বা তাতাল। শুধু সোল্ডারিং করতেই নয়, সোল্ডারিং তুলতেও ব্যবহার করা হয় এই তাতাল।
তাতাল নিয়ে আরেকটু জানি
তাতাল নামের এই যন্ত্রটির পুরো শরীরকে ভাগ করা যায় দুইটি ভাগে,
- বিট বা টিপ
- বডি
সোল্ডারিং বিটঃ একটি সোল্ডারিং আয়রন বা তাতালের প্রধান অংশ হলো সোল্ডারিং বিট বা টিপ। কারন তাতালের সম্মুখভাগের এই অংশটিই গরম হয়ে মূল ঝালাইয়ের কাজটি করে। এই বিট আবার হয় তিন ধরণের,
- সাধারণ বিট
- তামার বিট
- সিরামিকের বিট
সোল্ডারিং আয়রন বডিঃ সোল্ডারিং বিটের নিচ থেকে বাদ বাকি অংশ হচ্ছে বডি। এই বডির আবার দুটি অংশ। তাতালের যে অংশটি হাতে ধরে কাজ করা হয়, অর্থাৎ হাতল অংশটি তাপরোধী পদার্থ, যেমন প্লাস্টিক বা কাঠ দিয়ে তৈরী হয়। আর বাকি অংশটি টিন বা লোহা জাতীয় ধাতব পদার্থ দিয়ে।
তাতাল ব্যবহারের খুটিনাটি
সোল্ডারিংয়ের কাজ যে শুধু তাতাল হলেই হয়ে যায়, ব্যাপারটা কিন্তু এমন হয়। তাতালের সাথে সহায়ক হিসেবে থাকে গুরুত্বপূর্ণ আরো কতগুলি জিনিস, যেগুলো ছাড়া তাতাল যন্ত্রটি একা কোন কাজেরই না বলা চলে। যেমন,
- জোড়ক পদার্থ বা রাং
- ফ্লাক্স বা রেজিন
- সোল্ডারিং আয়রন স্ট্যান্ড
- কয়েল
জোড়ক পদার্থ বা রাংঃ দুইটি ধাতুকে তাতাল দিয়ে জোড়া দিতে যে একটি জোড়ক পদার্থ লাগে, সেটা তো আগেই বলেছি। এখন বলি এই জোড়ক পদার্থ জিনিসটা আসলে কী। জোড়ক পদার্থ হচ্ছে এমন এক ধরণের পদার্থ, যার গলনাঙ্ক যে ধাতুকে জোড়া দেয়া হবে তাঁর থেকে কম। এটি মূলত একধরনের সংকর পদার্থ, যার ৬০% টিন ও ৪০% সীসা দিয়ে তৈরি। গলনাংক হয় ৮০ থেকে ৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আরেক নাম ‘রাং’। বিশেষ ধর্মের কারনেই এই জোড়ক পদার্থকে তাতাল দিয়ে তাপ দিলে, নিজে গলে ধাতুর সাথে আটকে যায় এবং এক ধাতুকে অপর ধাতুর সাথে আটকে দেয়।
ফ্লাক্স বা রেজিনঃ অক্সিজেনের সাথে জোড়ক পদার্থের সীসা ও টিন বিক্রিয়া করে, অর্থাৎ অক্সিডেশন হয়। এতে জোড়ক পদার্থ অতিরিক্ত নরম বা গলে গিয়ে ঝালাই কাজী ব্যাঘাত যেন না ঘটে কিংবা ঝালাইয়ের কার্যক্ষমতা কমিয়ে না দেয়, সেইজন্য সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রাখে ফ্লাক্স বা রেজিন। এছাড়াও তাতালের বিট পরিস্কারের জন্যও ফ্লাক্স বা রেজিন ব্যবহৃত হয়।
সোল্ডারিং আয়রন স্ট্যান্ডঃ সোল্ডারিং আয়রন বা তাতাল দিয়ে কাজের সময় এটি প্রচুর উত্তপ্ত হয়ে যায়। তাই কাজের মাঝে কোথাও রাখতে হলে সেটা হতে হয় অবশ্যই তাপসহনীয়। তাই সাবধানতার সাথে কাজের সুবিধার্থে ব্যবহার করা হয় এই লোহার স্ট্যান্ড।
ডিসোল্ডারিং পাম্প বা সাকারঃ ইতোমধ্যে বলা হয়েছে যে, শুধু সোল্ডারিং করতেই নয়, সোল্ডারিং তুলতেও ব্যবহার হয় সোল্ডারিং আয়রন। সোল্ডারিং তোলার ক্ষেত্রে তাপ প্রয়োগ বা ঝালাইয়ের পর রাং নরম হলে যে জিনিসটা আলাদা করতে হবে সেটা কিন্তু মোটেও হাত দিয়ে স্পর্শ করে খোলা যাবে না। সেটা টেনে খুলতেই প্রয়োজন হয় ডিসোল্ডারিং পাম্প বা সাকারের।
কয়েলঃ বিদ্যুৎ শক্তিকে তাপশক্তিতে রূপান্তরিত করতে ব্যবহৃত হয় ইলেকট্রিক কয়েল। ইলেকট্রিক তারের মাধ্যমে এতে দেয়া হয় বিদ্যুৎ সংযোগ। চিনামাটি বা এলুমিনিয়ামের কোরের উপর খুব সূক্ষ্ম নাইক্রোমের তার পেচিয়ে তৈরি করা হয় কয়েল। কোরটির মাঝে সরু পাইপের মতো ফাঁকা হয়, যার ভেতর দিয়ে তাতালের বিট প্রবেশ করে। কোন তাতালের কয়েল যত ওয়াটের হয়, সেই তাতালও তত ওয়াটের বলেই গণ্য হয়।
একজন ইইই শিক্ষার্থীদের জন্য তাতালের প্রয়োজনীয়তা
উপরের বিস্তারিত বর্ণনায় আশা করি তাতাল বা সোল্ডারিং আয়রন যন্ত্রটি নিয়ে কিছুটা হলেও সাধারণ ধারণা পাওয়া গেছে। এবার বলবো একজন ইইই শিক্ষার্থীর সাথে তাতালের সম্পর্ক নিয়ে।
ইইই- ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং। নামেই বুঝতে পারছেন হয়তো, এদের পড়াশোনা, হাতেখড়ি থেকে শুরু করে হাতেকলমের কাজ সবই বলতে গেলে ইলেক্ট্রিক্যাল এবং ইলেক্ট্রনিক্সের সাথে জড়িত ব্যাপার স্যাপার নিয়ে। আর শুরুতেই বলেছি, সোল্ডারিং আয়রন বা তাতাল নামের যন্ত্রটির ব্যবহারও এই ইলেক্ট্রিক্যাল এবং ইলেক্ট্রনিক্সের সাথেই জড়িত। ইইই তে পড়াশোনা করেছেন, বা করছেন এমন কোন ব্যাক্তিকে পাওয়া যাবে না, যিনি শিক্ষা জীবন এবং শিক্ষা পরবর্তী জীবনে তাতালের ব্যবহার নিজ হাতে একবারও করেননি। তাতাল ব্যবহারে বেশ দক্ষ এমন ইইই শিক্ষার্থী কিংবা পাশ করা ব্যাক্তি কিন্তু আশেপাশে আপনার পরিচিতদের মাঝেই হয়তো খুজে পাবেন।
শুধু শিক্ষা জীবনে রেজাল্ট ভালো করার জন্যই যে সোল্ডারিং এবং তাতাল নিয়ে পড়াশোনা ও কাজ করে একজন শিক্ষার্থী, তা কিন্তু নয়। এর প্রচুর গুরুত্ব রয়েছে ইইই পাশ পরবর্তী একজন ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারের পেশাগত জীবনেও। এই কারনেই শিক্ষা জীবনেই একজন ইইই শিক্ষার্থীর সোল্ডারিং ও তাতাল নিয়ে হাতেকলমে যথেষ্ট জ্ঞ্যান অর্জনের গুরুত্ব অনেক বেশি।
একজন ইইই এর শিক্ষার্থী সোল্ডারিং আয়রন বা তাতাল ব্যবহারে কতটা দক্ষতা অর্জন করছে, সেটা আসলে নির্ভর করে, সেই বিশ্ববিদ্যালয় কতটা গুরুত্ব ও সময় দিয়ে হাতেকলমে একজন শিক্ষার্থীকে এর ব্যবহার ও কাজ শেখাচ্ছে তার উপর। এছাড়াও নিজের আগ্রহের ক্ষেত্র তো আছেই। ইতিবাচক দিক হচ্ছে, সোল্ডারিং আয়রন বা তাতালের ব্যবহার এখন শুধুই ইইই শিক্ষার্থী কিংবা ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের মাঝেই আঁটকে নেই। এর বাইরেও অন্যান্য বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করা বা পেশায় থাকা মানুষেরাও রোবটিক্স, ইলেকট্রনিক্সের প্রতি ব্যাক্তিগত আগ্রহ থেকেই আজকাল শিখছে ও কাজ করছে সোল্ডারিং আয়রন বা তাতাল নিয়ে।